গাড়িরও যে বডি আছে, মনেই থাকে না


আরও কিছুটা এগিয়ে কান্দালামা রোড ধরলাম। গোল্ডেন স্টারস হোটেলের রুম দেখে পিলে চমকে গেল। এ নিশ্চয়ই আমাদের বাজেটে কুলোবে না। তা-ও বলে দেখতেই রিসেপশনের ভদ্রমহিলা খানিকটা দোনোমনা করে রাজি হয়ে গেলেন। অফ সিজন বলেই খুব সম্ভবত। জুমন ভাইকে গেস্টহাউসে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। আমার গন্তব্য সিগিরিয়া। জুমন ভাই বছর দশেক আগে শ্রীলঙ্কায় এসে সিগিরিয়া ঘুরে গিয়েছিলেন। আবার যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। আজকের দিনের মতো এখানেই হাঁটা শেষ।
ব্যাকপ্যাক রেখে আমি উল্টো দিকের বাসস্ট্যান্ড পানে এগোলাম। সিগিরিয়ার অবস্থান আমাদের যাত্রাপথের বিপরীত দিকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার। বলা হয়ে থাকে, শ্রীলঙ্কায় এসে যদি কেউ একটা জায়গা দেখবে বলে মনস্থির করে, তবে সেই জায়গাটা অবশ্যই সিগিরিয়া হওয়া উচিত। অনেকে একে বলেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য! সিগিরিয়ার বাংলা প্রতিশব্দ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় সিংহের মতো দেখতে পাথর। প্রাচীন নগর-পরিকল্পনার সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন হিসেবে এটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে মাতালে জেলায়। এর নির্মাতা রাজা কশ্যপ। যদিও অনেকে বলেন, এর আগেও এখানে বসতি ছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মঠ হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর রাজা কশ্যপ পঞ্চম শতাব্দীতে অনুরাধাপুরা থেকে সরিয়ে এখানেই নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। নিজের পিতা ধাতুসেনাকে সরিয়ে এবং সিংহাসনের মূল দাবিদার সৎভাই মোজ্ঞাল্লানাকে বঞ্চিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনি। কশ্যপ ছিলেন ধাতুসেনার দাসির ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তান। অন্যদিকে রাজা ধাতুসেনার স্বীকৃত রানির সন্তান ছিলেন মোজ্ঞাল্লানা। নিজের পিতাকে জীবন্ত অবস্থায় চারপাশে প্রাচীরবেষ্টিত করে হত্যা করেন কশ্যপ। অনেকটাই মোগল সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের সেই স্নায়ু টান টান সম্পর্ক। এখানে দারা শিকোর ভূমিকায় আছেন মোজ্ঞাল্লানা। সৎভাই কশ্যপের জন্য প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান মোজ্ঞাল্লানা। তবে যাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করেন, ফিরে এসে সিংহাসন দখল করবেন। দারা শিকোর মতো ভাইয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়নি মোজ্ঞাল্লানাকে। উল্টো ভাইকে হটিয়ে নিজের প্রাপ্য ময়ূর সিংহাসন বুঝে নেন মোজ্ঞাল্লানা।
কশ্যপ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় চড়ে বসেছিলেন হাতিতে। হাতি কৌশলগত কারণে দিক পরিবর্তন করলে পেছনের সৈন্যরা ধরে নেন, সামনে শত্রুপক্ষের বিশাল বাহিনী আসছে। তাঁরা রাজাকে ওখানেই ফেলে রেখে পালিয়ে যান। নিজের সৈন্যদলকে পশ্চাদপসরণ করতে দেখে কশ্যপ ওখানেই নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অবশ্য দুলহাজ গতকাল ভিন্ন একটা ঘটনা বলেছিল। স্কুলে ওর এক শিক্ষকের কাছে শোনা ঘটনাটা। যুদ্ধযাত্রার সময় রাজা কশ্যপের হাতির সামনে বিশাল এক সাপ পড়েছিল। তাই দেখে হাতি উল্টো পথে ফিরলে বিদায়ঘণ্টা বাজে কশ্যপের শাসনের। অবশ্য মিথের সঙ্গে মিথ্যার খানিকটা সম্পর্ক থাকতেই পারে!
সিগিরিয়া কমপ্লেক্সের চারপাশে পরিখা খনন করা আছে। টিকিট কেটে মূল প্রাঙ্গণে ঢুকতেই প্রথমে ওয়াটার গার্ডেন। আর ওপরে তাকালেই সেই অতিকায় লায়ন রক। প্রায় দুই হাজার বছরের কালের আঁচড় সামলে সটান দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে চূড়ার ওপরের গাছগুলোও চোখে পড়ে। মিরর গার্ডেনের লালচে দেয়ালও নিচ থেকে চোখ এড়ায় না। হাতের বাঁয়ে অষ্টভুজাকৃতি পুকুর। বোধিঘর, ইমেজ হাউস আর স্তূপ দেখে পা রাখলাম বোল্ডার গার্ডেনে। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ডিমের আকারের একেকটা বোল্ডার। এখানে একটা শানবাঁধানো পথের ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা—To the summit! এবার টানা সিঁড়ি ভাঙার পালা। মাঝপথে লায়ন স্টেয়ারকেস। সিংহের পায়ের নখরসদৃশ এই দ্বার কাজ করত মধ্যবর্তী ফটক হিসেবে। কী নিখুঁত কাজ! এত বছর পরও এর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখে অবাক হতে হয়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *