মোনালিসা: চুরি যাওয়া আর ফেরত পাওয়া


আলফ্রেদো জেরি ইতালির ফ্লোরেন্সে চিত্রকর্ম আর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জিনিস কেনাবেচার ব্যবসা করেন। বোর্গো ওনিসসান্তি সড়কে তাঁর অভিজাত দোকান। আসন্ন ক্রিসমাস আর নববর্ষ মাথায় রেখে জেরি ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে ইতালিসহ ইউরোপের বেশ কিছু পত্রিকায় চিত্রকর্ম আর প্রাচীন সামগ্রী ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন দেন। এতে তিনি বেশ ভালো সাড়া পান। অনেক আগ্রহী বিক্রেতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিদিন ডাকে পাওয়া চিঠিগুলো থেকে উপযুক্ত সামগ্রীগুলো নির্বাচন করে তিনি তালিকা করতে শুরু করেন। সব চিঠি তাঁর কাছে সমান গুরুত্ব না পেলেও একটি চিঠি তাঁর নজর কাড়ে। চিঠিতে প্যারিসের এক পোস্ট অফিসের সিল ছিল। প্রেরকের নাম ‘লেওনার্দো’। স্বাক্ষরের তারিখ ২৯ নভেম্বর ১৯১৩। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘লেওনার্দোর চুরি যাওয়া শিল্পকর্মটি আমার কাছে আছে। আমি এটি ইতালির সম্পত্তি মনে করি। কারণ, এটির শিল্পী একজন ইতালিয়ান। আমার স্বপ্ন, শিল্পকর্মটি সে দেশে ফিরে আসুক, যেখান থেকে এটি আবির্ভূত আর অনুপ্রাণিত হয়েছিল। লেওনার্দো।’ তিনি চিঠিটি কয়েকবার পড়লেন। তাঁর মনে হলো চিঠিটি ভুয়া। তবে অপরিশীলিত ভাষা, বাহুল্যবর্জিত শব্দ আর স্বাক্ষরের অলংকরণ দেখে তাঁর খটকা লাগল।

মোনালিসা নিখোঁজ হওয়ার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে মোনালিসা উদ্ধার বা খুঁজে পাওয়ার অনেক ভুয়া গল্প ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকায় কখনো উল্লেখ থাকত যে মোনালিসাকে সুইজারল্যান্ডে দেখা গেছে, আবার কখনো বলা হতো যে সে হল্যান্ডে আছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মোনালিসার জন্য পুলিশ একাধিকবার ফ্রান্স থেকে আমেরিকাগামী জাহাজে তল্লাশি চালায়। শেষমেশ সব সংবাদই গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয়। ১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে এক ধনী ইংলিশম্যান প্যারিসে ব্রিটিশ দূতাবাসে মোনালিসার একটি নকল নিয়ে এসে দাবি করেন যে এটিই খোয়া যাওয়া মোনালিসা। পরে প্রমাণিত হয়, এটি ছিল খুব উন্নত মানের একটি নকল। সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ার একটি পত্রিকায় প্রকাশ পায় যে মোনালিসা সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি ব্যক্তিগত গ্যালারিতে ঝোলানো আছে। ১ নভেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে যে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চোরাই মোনালিসার জন্য পুলিশ ব্রংক্সের একটি অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালিয়েছে। এ ধরনের সংবাদ ইউরোপ ও আমেরিকায় অহরহ প্রকাশ পাচ্ছিল। এ কারণে অনেক আগে থেকেই জেরি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে কেউ না কেউ আসল মোনালিসার নামে নকল মোনালিসা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। আবার জেরি এ–ও জানত যে হারিয়ে যাওয়া মোনালিসা যদি সে উদ্ধার করতে পারে, তবে সে বিরাট সেলিব্রেটিতে পরিণত হবে এবং আরও ধনী হয়ে যাবে। প্রচার, প্রসিদ্ধি আর লিরার স্রোত তার দিকে ধেয়ে আসবে। চিঠির বিষয়টা আলোচনার জন্য তিনি জিওভান্নি পোগ্গির (Giovanni Poggi) কাছে ছুটলেন।

পোগ্গি ছিলেন ১৫৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত উফফিৎসি চিত্রশালার পরিচালক। পোগ্গি জেরির কথা শুনে খুব একটা আস্থা রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন যে এটা হয়তো বা খুব ভালো মানের নকল হতে পারে। তবে তিনি জেরিকে চিঠির উত্তর দিতে পরামর্শ দিলেন। জেরি ‘লেওনার্দোকে’ লিখলেন, ছবিটিতে তাঁর আগ্রহ আছে, তবে দেখার পর এটার দাম নিয়ে আলাপ করবেন।

জেরি সঙ্গে সঙ্গেই ‘লেওনার্দো’র উত্তর পেলেন। ‘লেওনার্দো’ জেরিকে প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানান। জেরি বিচক্ষণ ব্যবসায়ী, প্যারিসে গেলে বিপদের শঙ্কা থাকতে পারে ভেবে ‘লেওনার্দো’কে ইতালিতে আসার আহ্বান জানালেন। শেষে ঠিক হলো যে ২২ ডিসেম্বর ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় তিন শ ষাট কিলোমিটার দূরে মিলান শহরে তাঁরা মিলিত হবেন। ‘লেওনার্দো’ মোনালিসাকে যেকোনো মূল্যে বিক্রির জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অপেক্ষায় না থেকে ৯ ডিসেম্বরেই ট্রেনযোগে প্যারিস থেকে রওনা দিয়ে ফ্লোরেন্স পৌঁছে যান।

১০ ডিসেম্বর, বুধবার। জেরির দোকানে বেশ ভিড়, খরিদ্দারেরা জিনিসপত্র দেখছেন, দরদাম করছেন। এঁদের মধ্যে একজনকে একটু ভিন্ন রকম দেখাচ্ছে। সে বেশ আয়েশের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখছেন। খদ্দেরের ভিড় কমে এলে সেই ব্যক্তি জেরির কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘লেওনার্দো মোনালিসাকে তার নিজ শহরে নিয়ে এসেছে।’ জেরি লক্ষ করলেন যে ‘লেওনার্দো’ উচ্চতায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, হালকা–পাতলা, শ্যামলা বর্ণের। পাকানো মোচের অধিকারী এবং মোচের আগা মোম চর্চিত। হাবেভাবে চাটুকার ধরনের। পরনের সুটটা বেশ সস্তা। সে জানাল যে তার নাম লেওনার্দো ভিনসেনৎসো। সে উঠেছে জেরির স্টুডিওর কাছাকাছি পানৎসানি সড়কে অবস্থিত আলবার্গো ত্রিপোলি-ইতালিয়া হোটেলে।

ঘটনার আকস্মিকতায় জেরি কিছুটা হকচকিত হলেও লেওনার্দোকে পরদিন বিকেল তিনটায় আসার জন্য বললেন। জেরি জানতেন যে পরিচালক পোগ্গি ফ্লোরেন্স থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে বোলোনিয়া শহরে গেছেন। জেরি তাঁকে ফ্লোরেন্সে ফিরে অসার জন্য জরুরি তারবার্তা পাঠালেন। পরদিন তিনটার আগেই পোগ্গি জেরির দোকানে এসে পৌঁছালেন। এবার তাঁদের অপেক্ষার পালা। তাঁরা ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট, সাত মিনিট, দশ মিনিট—এভাবেই সময় এগিয়ে যাচ্ছে। পোগ্গি প্রথম থেকেই সন্দিহান ছিলেন। আর সময় নষ্ট না করে তিনি বিদায় নেওয়ার জন্য গায়ে কোট চড়ালেন। ঠিক এ সময়ে ‘লেওনার্দো’কে দরজায় দেখা গেল।

পোগ্গির পরিচয় পেয়ে ‘লেওনার্দো’কে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো। হাত মেলানোর সময় বললেন যে ফ্লোরেন্সের চিত্রশালার সংরক্ষকের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে খুব আনন্দবোধ করছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কালবিলম্ব না করে তাঁরা তিনজন ট্রিপোলি-ইতালিয়া হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দোকান থেকে বেরোনোর আগে ‘লেওনার্দো’ মোনালিসার জন্য পাঁচ লাখ লিরা দাবি করলেন, যা এখনকার সময়ের ২১ লাখ ডলারের সমান। জেরি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হলেন, তবে তা যদি আসল মোনালিসা হয়। হোটেলটি ছিল অত্যন্ত সাধারণ মানের। ‘লেওনার্দো’র কক্ষটি ছিল চতুর্থ তলায়। রুমের সাইজটাও খুব ছোট। তিনজন রুমে প্রবেশের পর নড়াচড়া করাই কঠিন হয়ে গেল। ‘লেওনার্দো’ দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন, কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানার নিচ থেকে মাঝারি আকারের সাদা কাঠের একটি বাক্স বের করে বিছানার ওপর রাখলেন। তিনজনের কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। ‘লেওনার্দো’ বাক্সটা খুললেন। বাক্সটা অনেক রকম জঞ্জাল, যেমন উলের আন্ডারগার্মেন্টস, কোঁচকানো জামা, এক জোড়া ছেঁড়া জুতা, একটি ভাঁজ করা টুপি, একটি ম্যানডোলিন, কিছু ছোটখাটো যন্ত্রপাতি, এমনকি ছবি আঁকানোর কিছু ব্রাশ দিয়ে ভর্তি ছিল। এসব কিছু ‘লেওনার্দো’ মেঝেতে নামিয়ে রাখার পর একটা নকল তলদেশ দেখা গেল। সেটা উঠিয়ে তার নিচ থেকে লাল সিল্ক কাপড়ে জড়ানো একটা বান্ডিল বের করে বিছানায় রাখলেন। নিঃশব্দে সে বান্ডিলটা খুলতে শুরু করলেন। এই মুহূর্তটা সম্পর্কে জেরি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বিস্ফারিত চোখের সামনে অক্ষত ও সুন্দরভাবে সংরক্ষিত মোনালিসা উদ্ভাসিত হলো। আমরা জানালার কাছে নিয়ে গেলাম। মোনালিসাকে আমাদের সঙ্গে আনা তার একটা ছবির সঙ্গে মেলানোর জন্য। পোগ্গি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন, আমাদের কোনো সন্দেহ রইল না যে এটি সত্যিকার মোনালিসা। ছবির পেছনের নম্বর ও চিহ্নের সঙ্গে ল্যুভরের ক্যাটালগে থাকা মোনালিসার পেছনের নম্বর ও চিহ্নের মিল আছে। জেরির মধ্যে কোনো সন্দেহ না থাকলেও পোগ্গি এটা তার চিত্রশালায় নিয়ে গিয়ে লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অন্যান্য চিত্রকর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। ‘লেওনার্দো’ রাজি হয়ে গেলেন। ‘লেওনার্দো’ আবারও মোনালিসাকে লাল সিল্ক দিয়ে জড়িয়ে ফেললেন। পোগ্গি ও জেরি সেটি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন।

হোটেল থেকে বেরোনোর সময় হোটেলের প্রহরী তাদের থামিয়ে চিত্রকর্মটি পরীক্ষা করলেন। মোনালিসাকে তিনি হোটেলে টাঙানো কোন চিত্রকর্ম সন্দেহ করেছিলেন। অশিক্ষিত প্রহরী মোনালিসার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, তাঁদের ছেড়ে দিলেন। তাঁরা ঊর্ধ্বশ্বাসে উফফিৎসির দিকে ছুটলেন আর মনে মনে ভাবলেন, এই নিরাপত্তাব্যবস্থা ল্যুভরে থাকলে মোনালিসাকে নিরুদ্দেশ হতে হতো না।

উফফিৎসিতে এসে তাঁরা মোনালিসাকে আরও সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করলেন। মোনালিসার গায়ে ছিল প্রায় পাঁচ লাখ ক্র্যাকুলার। ক্র্যাকুলার হচ্ছে পুরোনো ছবিতে থাকা ফাটা ফাটা দাগ। প্রায় প্রতিটি পুরোনো ছবিতে এ ধরনের ক্র্যাকুলার থাকে। ছবিভেদে ক্র্যাকুলারের সংখ্যা ও প্যাটার্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এই সংখ্যা ও প্যাটার্ন দিয়ে এগুলোকে চেনা যায়, অনেকটা মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো। পোগ্গি ও জেরি নিশ্চিত হলেন, মোনালিসা আজ সেখানেই আবির্ভূত হয়েছেন চার শ বছর আগে যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। জেরি মোনালিসার সঠিকতা নিশ্চিত বা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়ার পর পুলিশকে ফোন করলেন।

ফ্লোরেন্স থেকে রাজা ভিক্তর ইমানুয়েল, পোপ দশম পায়াস এবং ফরাসি রাষ্ট্রদূত কেমিলকে ফোন করে আনন্দের সংবাদটা পৌঁছে দেওয়া হলো। মোনালিসা উদ্ধারের সংবাদে ইতালিবাসী উচ্ছ্বসিত আর ফরাসিবাসী দ্বিধান্বিত হলেন। উফফিৎসির সম্মুখে জনতার ঢল নেমে এল। অনেকে সাশ্রুনয়নে মোনালিসার সঙ্গে ছবি তুলল। তাঁদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে। ইতালিয়ান চেম্বার অব ডেপুটিতে (সংসদ) বাগ্‌যুদ্ধ চলছিল। একজন চেঁচিয়ে উঠল—‘লা জোকোন্দা’ অর্থাৎ মোনালিসাকে পাওয়া গেছে। সব বাগ্‌যুদ্ধ থেমে গেল।

অপর দিকে ফ্রান্সের সরকার, চিত্রশালার কর্মকর্তা, গণমাধ্যম এবং জনতা—কেউই বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ল্যুভরের একজন কিউরেটরকে রাতে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি তখন নৈশভোজ করছিলেন। ফোন ধরে তিনি অবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘অসম্ভব’ এবং ফিরে গেলেন নৈশভোজে।

হারিয়ে যাওয়ার সময় মোনালিসা যেভাবে পত্রিকার প্রথম পাতা দখলে রেখেছিল, উদ্ধারের পর ঠিক একই অবস্থার সৃষ্টি হলো। মোনালিসা আবারও ইউরোপ আর আমেরিকার পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতা দখলে নিল। পত্রিকাগুলো একের পর এক প্রতিবেদন ছাপতে থাকল। দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ ২০ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারির মধ্যে মোনালিসাকে নিয়ে তিনটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল।

মোনালিসার উদ্ধারে ইতালিবাসী আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ উথলে পড়তে শুরু করল। তারা মোনালিসাকে ইতালিতেই রেখে দিতে চাইল। তাদের যুক্তি—মোনালিসার শিল্পী ইতালির, মোনালিসার জন্ম ইতালিতে, আর মোনালিসার মডেলও ছিলেন ইতালির। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান এটিকে চুরি করে ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব এ সম্পত্তি ইতালির, ফ্রান্সের নয়। তাদের অনেকে পেরুজ্জিয়াকে ধন্যবাদও জানাল। ১৯১২ সালে ইতালির লিবিয়া বিজয়ের নায়ক গাব্রিয়েলে দান্নুৎসিও একাধারে ছিলেন সেনাপতি, বিমানযোদ্ধা, কবি, নাট্যকার, বক্তা, সাংবাদিক। মোনালিসা উদ্ধারের পর তিনি পেরুজ্জিয়াকে অভিনন্দন জানান এবং চুরির বিষয়টি তাঁর মাথায় না আসার কারণে আক্ষেপ করতে থাকেন। ভাবটা এমন যে তাঁর মাথায় এলে তিনি মোনালিসাকে অনেক আগেই চুরি করে দেশে ফেরত আনতেন। ইতালি সরকার এ ধরনের আবেদনে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে, মোনালিসাকে ফ্রান্সে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে খুব তড়িঘড়ি করে চুক্তি করল। ঠিক হলো যে ফ্রান্সে যাওয়ার আগে ফ্লোরেন্স, রোম আর মিলানে মোনালিসার বিশেষ প্রদর্শনী হবে। এরপর সে ইতালি ত্যাগ করে প্যারিসে চলে যাবে।

২০ ডিসেম্বর মোনালিসা বিরাট প্রহরী দলসহ ট্রেনে চেপে রোমের পথে যাত্রা করল। প্রতিটি স্টেশনে নিরাপত্তাকর্মীরা সাদাপোশাকে সতর্ক অবস্থানে থেকে ট্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রোমে পৌঁছানোর পর মোনালিসাকে নেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। রাজা ইমানুয়েলসহ রাজধানীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাকে দর্শন দেন। সেখানে বিশেষ এক আয়োজনের মাধ্যমে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোনালিসাকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তান্তর করেন। এখান থেকে মোনালিসাকে ফরাসি দূতাবাসে নেওয়া হয়। দূতাবাসে ইতালির রানি, রানিমাতা, পুরো কূটনৈতিক মহল ও বিশিষ্টজনেরা মোনালিসাকে শ্রদ্ধা জানালেন।

এরপর মোনালিসাকে রোমানদের প্রদর্শনের জন্য ২৩ ডিসেম্বর ভিলা বোর্গেস গ্যালারিতে আনা হয়। প্রদর্শনী চলে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২৮ ডিসেম্বরের মোনালিসা রোম থেকে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে ২৯ ডিসেম্বর মোনালিসা মিলানবাসীর জন্য যাত্রাবিরতি করে। মোনালিসাকে একনজর দেখার জন্য সেখানে প্রায় ৬০০০০ দর্শক উদ্‌গ্রীবভাবে অপেক্ষা করছিলেন।

সব শেষে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে মোনালিসা ফ্রান্সে প্রবেশ করল। নববর্ষের প্রথম দিন মোনালিসা এসে পৌঁছাল প্যারিসে। প্যারিসের লে ইলাসত্রেসিওঁ পত্রিকা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে শিরোনাম করল—‘অবশেষে সে আবার ফ্রান্সে’। ল্যুভরে নেওয়ার আগে প্যারিসের বিশিষ্টজনদের জন্য তিন দিনের বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনী শেষে ১৯১৪ সালের ৪ জানুয়ারি, রোববার সকাল ১০টায় মোনালিসাকে নিয়ে প্যারিসবাসী বিরাট মিছিলসহ ল্যুভরে এসে পৌঁছায়। দর্শকের প্রবল চাপ সহ্য করার জন্য মোনালিসাকে প্রথম দুই দিন বড় একটা গ্যালারিতে জায়গা দেওয়া হয়। এরপর মোনালিসা ফিরে এল তার শত বছরের আবাস সালোঁ কেয়ারে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *