বোনেরা | প্রথম আলো


মঞ্চে উঠেছে তার ছাত্রী সাবিনা। সে বলতে শুরু করল—

‘১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হয়েছিল, সে সময় রণকৌশল হিসেবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশি মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। প্রায় ৯ মাসের এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২ লাখ থেকে ৪ লাখ বাংলাদেশি মহিলাকে ধর্ষণ অথবা অপহরণ করেছে।

‘২০১০ সালে কবি তারফিয়া ফয়জুল্লাহ ঢাকায় গিয়েছিলেন এই নৃশংসতা পেরিয়ে আসা মহিলাদের সাক্ষাৎকার নিতে, নতুন সরকার যাদের নাম দিয়েছিল বীরাঙ্গনা, যার আক্ষরিক অর্থ “সাহসী নারী”। তবে ভাবানুবাদ হতে পারে “যুদ্ধের নায়িকা”…’

সাদাফের মনে পড়ছে, এক প্রচণ্ড বৃষ্টির দুপুর। ক্লাস ফাইভে পড়ত সে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে কাকভেজা হয়ে। দেখে, উঠানের মাটির ওপর পা ছড়িয়ে বসে বুজি চিৎকার করে কাঁদছে। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে সারা শরীর। বৃষ্টি–কাদায় মাখামাখি হয়ে সে মাটির ওপর সর্বশক্তিতে আঘাত করছে অসম্ভব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে। আম্মা নিথর বসে আছে তার সামনে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে, ভ্রুক্ষেপ করছে না কেউ। সাদাফ যে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাকেও তারা খেয়াল করেনি। অনেকক্ষণ পর বুজি যখন শান্ত হলো, আম্মা বলল, ‘শরীরে ময়লা লাগে না, পানিতে ধুইলেই চলে যায়, দেখিস না, হাঁসেরা কেমন কাদার মধ্যে মাখামাখি করে, পানি থেকে উঠে গা ঝাড়া দেয়?’ তারপর ধীরে ধীরে বাচ্চা মেয়ের মতো হাত ধরে তুলেছিল তাকে আম্মা, পরম যত্নে গা মুছে কাপড় বদলে দিয়েছিল। সেদিন বুজি জানতে পেরেছিল যে তার গর্ভে সজল এসেছে…

সাবিনা পড়ছে তারফিয়া ফয়জুল্লাহর কবিতার অনুবাদ—

‘তা ছাড়া, আমার ভিতরে, বাইরে অথবা

পাশে আমি কখনোই তার, অথবা তার কিংবা

তার সন্তান চাই নাই। মেয়েটা কখনোই

 জানবে না যে তার মাথাটা হাতের মধ্যে নিয়ে

আমি খুব জোরে চেপে ধরতে
শুরু করেছিলাম, কিন্তু

 থেমে গেছি। জানবে না তাকে মাটির মেঝেতে

সুতির চাদরে ঢেকে শোয়ানোর পর আমার

 আঙুলের ডগায় তার 

স্পন্দিত বুক ছুঁয়েছিলাম…’

২০২৪–এ যখন হেলিকপ্টার থেকে সমানে গুলি ছোড়া হচ্ছিল, বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে হত্যা করা হচ্ছিল পাখির মতন, যেদিন পুলিশের গাড়ি থেকে জীবন্ত ইয়ামিনকে ছুড়ে ফেলা হলো মেরে ফেলার জন্য, বুজি সেই দিন খুব অস্থির হয়ে ফোন করেছিল। বারবার বলছিল, ‘সাদাফ, তোকে সবকিছু বলা হয় নাই…।’ জবাবে সাদাফ শুধু বলেছিল, ‘বুজি, সবকিছু জেনে কী হয় বলো? আমি জানি, তুমি যদি আমাকে ভালো না বাসতা, আমি দুনিয়ায় আসতাম না…তোমাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি বুজি, আমি ভালো আছি…’

শেখ হাসিনা যেদিন দেশ ছেড়ে পালাল, সেই দিন আলমারির কোনায় লুকিয়ে রাখা ছবিটা বের করেছিল সাদাফ—সেটাই একমাত্র পারিবারিক ছবি, যা সে আম্মার ট্রাংকের তলার থেকে চুরি করেছিল। ছবিটা ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে এখন তার ঘরের দেয়ালে অপেক্ষা করে। সে জানে, খোলা জানালা থেকে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে এখন সেখানে। একদিন নতুন চাঁদ উঠবে। যে অতীত ভয়ে, লজ্জায়, বিস্মৃতিতে কোণঠাসা হয়েছিল, তা নতুন আলোয় স্পষ্ট হবে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *