বৈষম্য কমানোর ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘লাল জুলাই’য়ের। বৈষম্য কাঠামোগত ব্যাপার। টিএসসিতে বা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে মুগ্ধ করা এক জিনিস, মানুষকে ঔপনিবেশিক আইনকানুনের বাঁধন মুক্ত করা ভিন্ন জিনিস।
সচিবালয়ে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেটা হবার নয়। রাষ্ট্রের ভেতরে ঢুকে রাষ্ট্র বদলানো দুরূহ। বলশেভিকরাও সেটা পারেনি। জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রকে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করতে হয়।
‘৩৬ জুলাই’ থেকে সেই অধ্যায় শুরুর দরকার ছিল। কিন্তু পরদিন থেকেই ঘটেছে উল্টো। সব সম্ভাবনা আটকে গেল ঢাকার রমনা ও মতিঝিলে।
মনে পড়ছে, রাস্তায় দেখা হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেবল বলতেন আমাদের দেশ গঠনের কাজ দিতে বলেন। বিষণ্ন হয়ে তাঁদের সামনে মাথা নুইয়ে থেকেছি।
‘২০২৪–এর আগস্ট’ বিপ্লব ছিল না। আবেগের বশে অনেকে সেটা বলে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করেছেন। কিন্তু ৩৬ জুলাই অবশ্যই একটা বিপ্লবী মুহূর্ত হাজির করেছিলেন শহীদেরা। এটা স্রেফ রেজিম চেঞ্জ ছিল না।
প্রতিটি উপজেলার মানুষ ভাবছিল এবার নতুন নায়কেরা, তাদেরই জীবিত সন্তানেরা তাদের কাছে আসবে, তাদের সঙ্গে নিয়ে দমনমূলক প্রশাসনিক ঐতিহ্য ভাঙতে। অভূতপূর্ব অহিংস এক কাফেলা তৈরি হতে পারত এভাবে। সেটা ঘটেনি।
৩৬ জুলাই হারিয়ে গেল ৮ আগস্টের ভেতর। ইন্তিফাদা ব্যর্থ হলো। সচিবালয় আত্মস্থ করে নিল তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর নতুন সম্ভাবনাকে।
কর্নওয়ালিশের আত্মা হয়তো হাসছিল তখন কোথাও বসে। গণ–অভ্যুত্থানের যৌথ গর্বকে পায়ে দলে ‘মাস্টারমাইন্ড’ খোঁজায় নামিয়ে দেওয়া হলো তাবৎ মিডিয়াকে।
চব্বিশের মূল দর্শন ছিল বৈষম্যের অবসানে রাষ্ট্র সংস্কার। এ দেশে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার কৃষক, শ্রমিক, দলিত এবং নারী সমাজ।
গত ৮ হাজার ৭৬০ ঘণ্টায় কৃষক-শ্রমিক-দলিত ও নারীদের ভাগ্য বদলতে মৌলিক কী পদক্ষেপ পেলাম আমরা? এক বছরে যতগুলো কমিশন হলো, তাতে কৃষি খাত বাদই থাকল। শ্রমিকদের বিষয়েও প্রথমে কোনো কমিশন ছিল না।
পরে সেটা হলো এবং ৪৪৫ পাতার চমৎকার প্রতিবেদনও জমা পড়ল। তারপর সুনসান নীরবতা। শ্রম খাত বিষয়ে কোনো সুপারিশ নিয়ে কোথাও কোনো আলাপ নেই, বিতর্ক নেই।
দলিত, সংখ্যালঘু, পাহাড়িসহ ছোট ছোট দুঃখী জনগোষ্ঠীগুলোর হাতে কোন প্রাপ্তি নিয়ে গণ–অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপন করবে? কী দেওয়া হলো তাঁদের? মাঝখানে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাও বাদ পড়ল। জায়গা হলো না বহুত্ববাদেরও।