আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুড: বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। আরব বসন্ত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ ছাড়াও ফিলিপাইনে, ফ্রান্সে, লাতিন আমেরিকায়। এমনকি ইউরোপেও। তবে আমি এখানে একটি খুব মৌলিক বিষয় আছে মনে করি। বাংলাদেশের গত ১০-১৫ বছরের ইতিহাসে, দেখবেন যে স্বৈরশাসনকে প্রতিহত করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা হয়েছে। এর সব কটি বিদ্রোহ নয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ বলা যায়। ফেসবুকে সমালোচনা, দেয়াললিখন, কর নিয়ে প্রতিবাদ। আবার কোটা বা নিরাপদ সড়ক নিয়ে বড় আন্দোলন হয়েছে।
তারা বলতে চেয়েছে যে স্বৈরাচারীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কিন্তু আমরা সব সিদ্ধান্ত পছন্দ করছি না। তাই স্বৈরাচারীরা তথ্য দেওয়া-নেওয়া এবং আলোচনার, তর্কবিতর্কের জায়গা সীমিত করে দেয়। একেই বলে স্বৈরাচারীকরণ। স্বৈরাচারীদের কথা উঠলে তাদের খুব দৃঢ়, খুব শক্তিশালী বলে মনে হয়। তবে একটা মৌলিক বিষয় হলো, স্বৈরাচারীরা মৌলিকভাবে দুর্বল। তারা সহজেই ক্ষমতা হারাতে পারে। কারণ, তারা নিজেদের তৈরি করা এক কাঠামোর ওপর ভর করে টিকে থাকে। এই কাঠামো টিকিয়ে রাখতে অনেক ব্যয় করতে হয়। লাগে ভাগ্যের সহায়তা।
শেখ হাসিনা এমনই এক কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন—সব রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ইত্যাদিকে নিজের কাজে লাগিয়ে। কিন্তু একে তো বৈধতাও দিতে হবে। তাই সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো ব্যাপার নিয়ে আসতে হয়। নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় জনকল্যাণমুখী সরকার হিসেবে। সেতু, রাস্তাঘাট নির্মাণ, এমন সব দৃশ্যমান কাজ করেছে বিগত সরকার। কিন্তু এই নড়বড়ে বৈধতা ধসে পড়ে গেল শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করা শুরু করে।
তবে এই একটি ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রবল গণতান্ত্রিক অভিপ্রায় আছে। ১৫ বছর ধরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিরোধ চলেছে। ছাত্রদের হত্যা জুলাই মাসে সরকারের বৈধতা চূড়ান্তভাবে ক্ষুণ্ন করে। কীভাবে তা ঘটল?
প্রথমত, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ—আমার ভাই মরল কেন। সমাজের বৃহত্তর গোষ্ঠীও হঠাৎ করেই সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ…এদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে। আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আপনি সাহায্য করতে পারেন? বাংলাদেশে একটি নেটওয়ার্ক সোসাইটি রয়েছে। সেটি এককথায় একটি দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক প্রশ্ন তোলে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং কর্মকর্তাদের কাজের বৈধতা নিয়ে। তাই যারাই শেখ হাসিনার তৈরি করা কাঠামোর অংশ ছিল, বৃহত্তর সমাজ তাদের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। পুরো পটভূমিই পাল্টে দেয় এই পরিবর্তন।
সব মিলিয়ে জুলাই মাস নাগাদ মানুষ ভাবে যে, যথেষ্ট হয়েছে। এই শাসন নৈতিকভাবে টেকসই ছিল না। সারা বিশ্বে স্বৈরশাসকদের সঙ্গে এটাই হয়। এ কারণে বিদ্রোহ হয়। এমনই ঘটেছে শ্রীলঙ্কায়, ফিলিপাইনে। অনেক দিন ধরেই অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল। সেই অসন্তোষ ওপর থেকে আপনি দেখতে পাবেন না। এবং আপনি যত একে দমিয়ে রাখবেন, তলেতলে তা ততই ফুটতে থাকবে। তারপর হঠাৎ বিস্ফোরণ। আরব বসন্ত, শ্রীলঙ্কা বা অন্যান্য এ রকম অভ্যুত্থানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে।