বাংলাদেশের ইতিহাস বর্তমান মিসরের মতো নয়। আবার এই বাংলাদেশ সেই আগের বাংলাদেশও নয়। এত বছর সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার পর আসলে কে জিতবে, সে ব্যাপারে নানা ধোঁয়াশা আছে এবং থাকবে। বাম প্রগতিশীল এবং নারীবাদী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে ডানপন্থী কর্তৃত্ব এই অভ্যুত্থানের বিফলতা। তবে আন্দোলনের আশাবাদী মুহূর্তেও আশা-নিরাশার বলয়ে আদিবাসী সমাজ ভুগেছে সবচেয়ে বেশি। ১৯৪৭, ১৯৬২, ১৯৭১, ১৯৭৬, ১৯৮১, ১৯৯০, ২০০৭, ২০২৪—পূর্ববঙ্গ, তারপর পূর্ব পাকিস্তান এবং সর্বশেষে বাংলাদেশের বহু পটপরিবর্তনের মাইলফলকে পৌঁছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সবার আগে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আমরা মব স্বৈরতন্ত্রের আশু প্রকাশ দেখি আদিবাসী মিছিলের ওপর ‘অজ্ঞাত’ আততায়ীদের আক্রমণে। আবার এই সরকারের আমলেই পাঠ্যপুস্তকের অলংকরণে গাছের পাতায় ‘আদিবাসী’ লেখার দায়ে পুরো পুস্তক পরিবর্তনের চাপ আসে।
এই ভূখণ্ডের প্রতিটি পটপরিবর্তনের সময় ‘কে বা কাহারা’ আমাদের আদিবাসী সম্প্রদায়কে সবার আগে কোণঠাসা করেছে। ১৯৪৭ সালের বিতর্কিত র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ যদি ইসলাম ধর্ম-প্রধান পাকিস্তানের সীমানা এঁকে দেয়, তাহলে কি যুক্তিতে ৯০ শতাংশের বেশি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পার্বত্য চট্টগ্রাম সেই পাকিস্তানের ভেতরে পড়ে? পাকিস্তান আমলে যখন ১৯৬২ সালে প্রথম ‘উন্নয়ন মহাপ্রকল্প’ পূর্ব পাকিস্তানে আসে, সেই কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ বাঁধ হাজার হাজার চাকমা পরিবারকে জলোচ্ছ্বাসে ডুবিয়ে ফেলে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আসে আরেক আইনি আগ্রাসন, নতুন দেশের সংবিধান বলে দেয়, এই ভূখণ্ডে সবাই বাঙালি। আইনিভাবে জাতিসত্তা মুছে ফেলার অভিযানের বিপক্ষে বাংলাদেশ সংসদে প্রথম ‘না’ আসে মানবেন্দ্র লারমার গলায়। জবাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আদিবাসীদের হুকুম করে, ‘তোমরা বাঙালি হয়ে যাও।’ অথচ দুই দিন আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘উর্দু শেখো, পাকিস্তানি হও’ স্লোগানের বিপক্ষে এই বাঙালিরাই বলেছিল, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’