১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরি যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে। এখানে যুক্ত ছিলেন ১৮৩১ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলা ভাষাসংক্রান্ত ব্যাকরণ, অভিধান ও বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার পাশাপাশি বাংলা ও অন্যান্য বহু ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বাংলা হরফ সংস্কারেও বড় ভূমিকা রাখেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রসিদ্ধ সতীদাহ-নিবারক আইনের অনুবাদও তাঁর হাত ধরেই। মূলত শ্রীরামপুর ব্যাপস্টিট মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্বেই তিনি বাংলা গদ্যের বিকাশে সামনে থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কলেজের ছাত্রদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতে নিজে যেমন একের পর এক বইয়ের কাজ করেছেন, তেমনি স্থানীয় পণ্ডিতদেরও উৎসাহিত করেছেন। তাঁর সেই উদ্যোগ ও উৎসাহেই বাংলা গদ্য পায় প্রাথমিক রূপ। কেরির বিখ্যাত বই ‘কথোপকথন’ ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে প্রকাশিত। বইয়ের ভূমিকায় ‘৪ঠা আগস্ট’ তারিখ দেওয়া রয়েছে। কেরির রচিত বইগুলোর মধ্যে কথোপকথন বইটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বই যেমন বাংলা প্রবাদ ও প্রবচনের বৈচিত্র্যে ভরপুর, তেমনি সে যুগে মৌখিক ভাষা শেখার জন্য এর বিকল্প ছিল না। এই বইয়ে ‘চাকর ভাড়াকরণ’, ‘সাহেবের হুকুম’, ‘সাহেব ও মুনশি’, ‘ভোজনের কথা’, ‘যাত্রা’, ‘পরিচয়’, ‘ভূমির কথা’, ‘মহাজন আসামি’, ‘বাগান করিবার হুকুম’, ‘ভদ্রলোক ভদ্রলোক’, ‘মজুরের কথাবার্ত্তা’, ‘ঘটকালি’, ‘হাটের বিষয়’সহ মোট ৩১টি অধ্যায় আছে। বইয়ের বাঁ পাতায় মূল বাংলা এবং বইয়ের ডান পাতায় কেরির ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়েছে। এই বইয়ের ভাষার একটি উদাহরণ:
‘মজুরের কথাবার্ত্তা
‘ফলনা কায়েতের বাড়ী মুই কায করিতে গিয়াছিনু তার বাড়ী অনেক কায আছে। তুই যাবি।
‘না ভাই। মুই সে বাড়ীতে কায করিতে যাব না। তারা বড় ঠেঁটা। মুই আর বছর তার বাড়ী কায করিয়াছিলাম মোর দুদিনের কড়ি হারামজাদগি করিয়া দিলে না মুই সে বেটার বাড়ী আর যাব না।
‘কেন ভাই? মুইত দেখিলাম সে মানুষ বড় খারা মোকে আগু এক টাকা দিয়াছে আর কহিয়াছে তুই আর লোক নিয়া আসিস মুই আগাম টাকা দিব তাকে।
‘আচ্ছা ভাই। যদি তুই মোকে সে বাড়ী নিয়া যাবি, তবে মুই তোর ঠাঁই মোর খাটুনি নিব।
‘ভালো ভাই। তুই চল, তোর যত খাটুনি হবে তা মুই তোকে দিব।’
বাংলা গদ্যের প্রথম যুগকে এ জন্য অনেকে উইলিয়াম কেরির প্রভাবের যুগও বলেন। উইলিয়াম কেরির লেখা অন্য বইগুলো হলো ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ (১৮০১); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-মোশার ব্যবস্থা’ (১৮০২); ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত’ (১৮০২); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-দাউদের গীত’ (১৮০৩); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-ভবিষ্যদ্বাক্য’ (১৮০৭); ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট-য়িশরালের বিবরণ’ (১৮০৯); ‘ইতিহাসমালা’ (১৮১২)।