যখন এই বাংকারের বাইরের জগৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, প্রতিদিন হিটলার তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ব্যারাকে কাঠের টেবিলের চারপাশে দাঁড়াতেন। মাত্র একটি বৈঠকের মধ্যেই তাঁরা মানচিত্রে আঙুল ঘুরিয়ে দোনেৎস অববাহিকা থেকে সিসিলি, সেখান থেকে ফ্রান্স, ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর; এরপর বলকান, দক্ষিণ আটলান্টিকে রিও ডি জেনিরোর কাছে নৌবাহিনীর একটি ডুবিয়ে দেওয়ার সফলতা, তারপর আবার নরওয়ে, এমনকি উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে চলে যেতেন। এসব জায়গায় তখন যুদ্ধ চলছিল।
এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে ভেরমাখট বা জার্মান সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু কর্মকর্তা হিটলারকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। পরাজয় যখন আরও কাছে এগিয়ে আসছিল এবং অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হচ্ছিল, তখন ভল্ফশাঞ্জের বাইরে কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা পরিকল্পনা করেছিলেন হিটলারকে ক্ষমতাচ্যুত করার। ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই, ওয়েহরমাখট কর্মকর্তা ক্লাউস শেঙ্ক গ্রাফ ফন স্তাউফেনবের্গ ভল্ফশাঞ্জে হিটলারের নিশ্ছিদ্র আস্তানায় একটি টাইমবোমা ফাটান। বোমা বিস্ফোরিত হলেও হিটলার অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। শুধু তাঁর প্যান্টের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে যায় এবং শরীরের কয়েক জায়গায় আঘাত পান। এর পর থেকেই তিনি একপ্রকার ষড়যন্ত্র–ভীতিতে ভুগতে থাকেন, এই কথা বলেছিলেন তাঁর শ্রোডার। এই হত্যাচেষ্টার পর ভল্ফশাঞ্জে নিরাপত্তাবোধ নিয়ে হিটলারের মনে সংশয় তৈরি হয়।
এরই মধ্য হিটলারের অসুস্থতা ক্রমে বাড়তে থাকে। তার বাঁ হাত ও বাঁ পা ক্রমাগত কাঁপতে থাকে। এর সঙ্গে তাঁর জন্ডিসও ধরা পড়ে। এই পরিস্থিতিতে কোকেনের দ্রবণ দিয়ে তাঁর চিকিৎসা করা হয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তিনি মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। কাছের মানুষদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা ও বিষণ্ন থাকার অভ্যাস তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি তাঁর বাংকারে নিজেকে বন্দী করে ফেলেন এবং কেবল একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতেন না। হিটলারের সেক্রেটারি ট্রাউডল ইউঙ্গের ভাষ্যমতে, ‘তিনি, এমনকি তাঁর কুকুর ব্লন্ডির সঙ্গে প্রতিদিনের হাঁটার অভ্যাসও ত্যাগ করেন।’
‘হিটলার তখন স্পষ্টতই একজন অসুস্থ মানুষ’, মন্তব্য করেছিলেন ভল্ফশাঞ্জে ভেরমাখট অপারেশনাল স্টাফের উপপ্রধান ভাল্টার ভার্লিমন্ট। তিনি বলেছেন, ‘ঝুঁকে পড়ে আর ধীর পদক্ষেপে তিনি মিটিং রুমে প্রবেশ করতেন। আর কেবল সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিদের দিকেই তিনি কাচের মতো দৃষ্টিতে তাকাতেন। কুঁজো হয়ে, মাথা কাঁধের মধ্যে গুঁজে, তিনি তাঁর জন্য ঠেলে দেওয়া চেয়ারে বসে থাকতেন।’
তখন প্রতিদিন মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমান ভল্ফশাঞ্জের গভীর অরণ্যের ওপর দিয়ে উড়ে যেত এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী কাছাকাছি চলে আসার সংবাদ আসছিল।